কয়েকদিন আগে আমাদের দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে আমার পছন্দের একটি দৈনিক পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক ‘রাষ্ট্র বনাম মির্জা ফখরুল’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। ওই নিবন্ধে লেখক সাবেক বিমান প্রতিমন্ত্রী এবং বিএনপি দলটির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের চারিত্রিক গুণাবলী সম্পর্কে প্রশংসামূলক অনেক কথাই লিখেছেন। সবকিছুর উত্তর দেয়ার আমার কোন ইচ্ছা নেই। তবে এমন সম্মানিত ব্যক্তির শুধু একটি বিষয়ে আমি মৃদু প্রতিবাদ করছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (সব অধ্যাপকই আমাদের মতো আমজনতার কাছে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র) সাহেব তার নিবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন, মির্জা সাহেব খালেদা জিয়ার আমলে প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অনিয়মের কোন অভিযোগ কখনও উচ্চারিত হয়নি। কথাগুলো পড়ে রবিঠাকুরের গানের একটি কলি মনে পড়ে গেল ‘সখী ভালোবাসা কারে কয়!’ ওই গানের কলিটি স্মরণ করে এবং শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকের লেখাটা পড়ে, বলতে ইচ্ছা করে, সখী মিথ্যা কাহারে কয়!
অ ঢ়ড়ষরঃরপরধহ রং বরঃযবৎ ধ মবহঃষবসধহ ড়ৎ ধ ংপযড়ষধৎ, নঁঃ ড়ভঃবহ পড়সনরহবং ঃযব ড়িৎংঃ ড়ভ বধপয. অধ্যাপক সাহেব তার লেখা নিবন্ধে যাদের অনেক প্রশস্তি গেয়েছেন তাদের প্রসঙ্গে কিন্তু কথাগুলো বলছি না। কেবল মনে পড়ে গেল, তাই লিখলাম। এ কথাগুলো কোন বইয়ে পড়েছিলাম, তাও মনে করতে পারছি না।
এবার বিমানের প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে মির্জা সাহেব বিমানের কতটা ক্ষতি করে গেছেন, তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক।
বেগম খালেদা জিয়া ২০০১ সালে দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো বাংলাদেশ বিমানের জন্য ১১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ১০ খানা নতুন এ্যারোপ্লেন কেনা হবে। বিমানের ফ্লিট প্ল্যান কমিটি তাদের বিদ্যার সীমাবদ্ধতা নিয়ে অনেক গবেষণা করে এবং অনেক সময় ব্যয় করে ২০০৩ সালের শেষদিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে: নতুন প্লেনগুলো বোয়িং কোম্পানি থেকেই কেনা হবে। বিমানের বোর্ড সভায় তা অনুমোদিত হলো।
তারেক রহমান জানতেন না, বোয়িং কোম্পানি থেকে প্লেন কিনলে কোন কমিশন পাওয়া যাবে না। আমেরিকার ফেডারেল আইন অনুযায়ী ওই দেশের কোন কোম্পানি বিদেশে কিছু বিক্রি করার জন্য কাউকে কোন কমিশন দিতে পারবে না। কিন্তু অনুদান দিতে পারে। ওই অনুদান আবার ব্যক্তি বা কোন গোষ্ঠীকে দেয়া যাবে না। ব্যাপারটা জানার পর তারেক রহমানের তো আক্কেলগুরুম। এত বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে এ্যারোপ্লেন কিনব, অথচ কোন কমিশন পাওয়া যাবে না, তা কি হয়! তবে আর প্লেন কিনে লাভ কি? তারেক রহমান তখন তখনকার বিমানের প্রতিমন্ত্রী মীর নাসিরকে বললেন, আমরা বোয়িং কোম্পানি থেকে উড়োজাহাজ কিনব না। আমরা কিনব, এয়ার বাস কোম্পানি থেকে প্লেন। মীর নাসির পড়ে গেলেন মহাবিপদে। বিমান বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে, সব বোর্ড সদস্যের সম্মতিক্রমে তিনি বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ ক্রয়ের অনুমোদন দিয়েছেন। এখন কোন অজুহাত দেখিয়ে বোয়িং প্লেনের পরিবর্তে এয়ারবাস এ্যারোপ্লেনের পক্ষে নিজের সিদ্ধান্ত বদলাবেন?
তারেক রহমান তার মাকে বলে মীর নাসিরকে মন্ত্রিত্বের পদ থেকে অপসারিত করে নিজের একান্ত অনুগত মির্জা ফখরুল ইসলামকে বিমানের প্রতিমন্ত্রী পদে নিয়োগদানের ব্যবস্থা করলেন। মির্জা সাহেব প্রতিমন্ত্রী হয়েই বিমানের ফ্লিট প্ল্যান কমিটিকে নির্দেশ দিলেন, বোয়িং প্লেন বাদ দিয়ে এয়ারবাস প্লেন কেনার জন্য নতুন করে পরিকল্পনা করতে। ব্যাপারটা সহজ ছিল না। এক বছরেরও বেশি সময় নিয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যাত্রী বহনের উপযুক্ততা, সিট-মাইলের কস্ট বা মূল্য ইত্যাদি হিসাব করে তৈরি করা ফ্লিট প্ল্যান বললেই তো আর রাতারাতি পরিবর্তন করা যায় না। তবু ফ্লিট প্ল্যান কমিটি অনেক রকমের যুক্তিতর্কের উপস্থাপনা করে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আপতত ৪ খানা বিভিন্ন মডেলের এয়ারবাস প্লেন ক্রয় করা হবে। বোয়িং প্লেনের বিষয়টা পরে দেখা যাবে।
এ্যারোপ্লেন ক্রয় করার জন্য বিদেশী ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থাও করা হলো। কিন্তু বিদেশী ব্যাংকগুলো চাইল, বাংলাদেশ ব্যাংক কম করে হলেও উড়োজাহাজগুলোর মোট মূল্যের ১৫ শতাংশ পেমেন্টের গ্যারন্টার হতে হবে।
প্রয়াত সাইফুর রহমান সাহেব তখন বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী। সিলেট বিমানবন্দরের উন্নয়নের জন্য তখন ২৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। ওই প্রকল্পের কাজটি পাওয়ার জন্য বিএনপি দলের গুম হওয়া নেতা ইলিয়াস আলী সমর্থিত একটি গ্রুপ ছিল। অন্য আর একটি গ্রুপ ছিল সাইফুর রহমান সাহেবের বড় পুত্র নাসের রহমান কর্তৃক সমর্থিত। সাইফুর রহমান সাহেব স্বাভাবিকভাবেই চেয়েছিলেন তার ছেলের সমর্থক গ্রুপটি কাজটি পাক। ইলিয়াস আলীর পেছনের জোরটা ছিল তারেক রহমানের আশীর্বাদ। এই সমর্থন, আর্শীবাদ ইত্যাদির সঙ্গে অবশ্যই জড়িত ছিল বড় অংকের অর্থকড়ি। বিষয়টা উল্লেখ না করলেও চলত। যা হোক, শেষ পর্যন্ত ইলিয়াস আলী গ্রুপই প্রকল্পের কাজটি পেয়ে যায়। এতে করে সাইফুর রহমান সাহেব তো রেগেমেগে একাকার। রাগান্বিত হয়ে প্রথমে তো তিনি পদত্যাগের হুমকি দিলেন। তিনি কেন পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন, তা তো দেশবাসীও জানতে পারল না। কিন্তু কেন পদত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন, দেশবাসী অবশ্যই তা জানতেন না।
বার্ষিক বাজেট উপস্থাপনের আগে অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগের হুমকি বিএনপি দলটির নীতিনির্ধারকদের চিন্তায় ফেলে দিল। কিন্তু পদত্যাগের কথা বললেই তো তা করা যায় না। সাইফুর রহমানের পুত্রধনরা তো সততার ব্যাপারে ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না। পুত্রধনদের তো তারেক রহমানের আক্রোশ থেকে বাঁচাতে হবে! অর্থমন্ত্রী সাহেব আর পদত্যাগ করলেন না।
সাইফুর রহমান সাহেব পদত্যাগ করলেন না বটে, কিন্তু উড়োজাহাজ কেনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টি দেয়ার কাজটা বন্ধ রাখলেন। তিনি গ্যারান্টির চিঠি ইস্যু করতে সরাসরি অস্বীকার না করে নানা টালবাহানা করে কাজটি বিলম্বিত করতে শুরু করলেন। টালবাহানার ধরনটা ছিল এমন যে, দরকষাকষি করে উড়োজাহাজের দাম কিছুটা কমানো যায় কিনা। এমন মহৎ প্রচেষ্টাÑ কোন মডেলের উড়োজাহাজ বিমানের জন্য বেশি উপযোগী হবে, এমন ধরনের প্রশ্নের সদুত্তর চাচ্ছিলেন। এমনি করে কালক্ষেণ করতে করতে বিএনপি দলটির ক্ষমতাসীন থাকার সময় ফুরিয়ে গেল।
এদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তারেক রহমান এনারা চুপচাপ বসে ছিলেন না। পুরনো ডিসি-১০ প্লেন দিয়ে যে বাংলাদেশ বিমান চালিয়ে রাখা সম্ভব নয় এবং জরুরী ভিত্তিতে যে নতুন এ্যারোপ্লেন কিনতে হবে, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে মির্জা ফখরুল এবং জিয়াপুত্র ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখলেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এক এক করে বিমানের ৫ খানা ডিসি-১০ প্লেনের মধ্যে ৪ খানাই অচল করে রাখলেন। ওই সময় উক্ত প্লেনগুলো ভাল সার্ভিসই দিচ্ছিল। বিমানের কোন গন্তব্যে যেতেই ডিসি-১০ প্লেনগুলোর কোন বাধা ছিল না। ওই প্লেনগুলোর ইঞ্জিনের ডি-চেক করার তখন ব্যবস্থা করা হয়েছিল হল্যান্ডের ডাচ এয়ারলাইনের সঙ্গে। পরে ব্যবস্থা করা হয় জার্মানির একটি কোম্পানির সঙ্গে। ডিসি-১০ প্লেনের এক একটা ইঞ্জিন ডি-চেকের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়, কিন্তু মেইন্টেন্যান্সের অর্থ পরিশোধ করে সেগুলো আর ফেরত আনা হয় না। এক এক করে এমনিভাবে ডিসি-১০ প্লেনের ১০টি ইঞ্জিন বিদেশে পড়ে রইল। ফলে ৫ খানার মধ্যে ৪ খানা ডিসি-১০প্লেন আর উড্ডয়নক্ষম রইল না। এর চাপ পড়ল বিমানের তখনকার ৩ খানা এয়ারবাস এ্যারোপ্লেনের ওপরও। এমনি করে বিমানের সমস্ত সিডিউল ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ল।
২০০৬ সালে মির্জা সাহেব যখন বিমানের প্রতিমন্ত্রী তখনকার কয়েকটি দিনের ফ্লাইট সিডিউলের বিপর্যয়ের খ-কালীন একটি চিত্র তুলে ধরছি: ২০০৬ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি মাত্র এক সপ্তাহের চিত্র। উক্ত এক সপ্তাহে বিমানের ৪১টি ডিসি-১০ প্লেনের ফ্লাইটের একটি ফ্লাইটও সময়মতো ছাড়তে পারেনি। মাত্র একটি ফ্লাইট অল্প বিলম্বে ছেড়েছিল। বাকি ৪০ টি ফ্লাইট অনেক বিলম্বে ছেড়েছে অথবা ক্যান্সেল হয়েছে। ওই একই সময় এয়ারবাস-৩১০ প্লেনের ১১৬টি ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র ১৭% ফ্লাইট নিয়মিত সময় চলাচল করেছে। এর পরের সপ্তাহে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি ডিসি-১০ প্লেনের ৬৭টি ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র একটি ফ্লাইট সময়মতো ছেড়েছিল। এয়ারবাস প্লেন দিয়ে পরিচালিত ৯৬টি ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র ১৬টি চলেছিল নিয়মিত সময়ে। ওই সময় একটানা ২১ দিন সময় যাবত বিমানের ডিসি-১০ প্লেনের কোন ফ্লাইটই সময়মতো চলাচল করেনি।
ডিসি-১০ প্লেনের ১০টি ইঞ্জিন ইচ্ছাকৃতভাবে বিদেশে ফেলে রাখা এবং ফ্লাইট সিডিউল সংক্রান্ত যে সব তথ্য পরিবেশন করা হলো, সে সবের রেকর্ড, কাগজপত্র সবই বিমান অফিসে আছে। তাই এ লেখার বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করলেই এ সবের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সময় নিউইয়র্কে নর্থ আটলান্টিক ট্রাভেল এজেন্সি নাম দিয়ে বিএনপিঅলাদের কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি মিলে একটি সিন্ডিকেট করে। মির্জা সাহেব বিমানের নিউইয়র্ক অফিসকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিলেনÑবিএনপিঅলাদের ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ছাড়া অন্যরা বিমানের টিকেট বিক্রি করতে পারবে না। ওই ট্রাভেল এজেন্সিগুলো নিউইয়র্ক-ঢাকা-নিউইয়র্কের জন্য নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অনেক বেশি ভাড়া আদায় করত। ফলে ঢাকা-নিউইয়র্কের মধ্যে বিমানের যাত্রী কমতে শুরু করল। এক পর্যায়ে বিমানের ঢাকা-নিউইয়ের্কের ফ্লাইটই বন্ধ করে দিতে হলো।
এ সব ছাড়া মির্জা সাহেবের মন্ত্রিত্বের সময়ের অন্যান্য দুর্নীতির বিষয় আলোচনা করলাম না লেখাটার কলেবর বৃদ্ধি না করার ইচ্ছা থেকে। আমার বক্তব্য হলো, বাংলাদেশ বিমানের বর্তমান বেহাল অবস্থার সূচনাটা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই করে গেছেন। একবার যদি কোন এয়ারলাইন্সের ওপর যাত্রীরা আস্থা হারিয়ে ফেলে, তবে ওই এয়ারলাইন্স আর সহজে ঘুরে দাঁড়াতে পারে না।
শুনেছি ম্যাকারেল মাছের পচন ধরলে ওগুলোকে নাকি বেশি শাইনিং (ঝযরহরহম) দেখায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অধ্যাপক লিখেছেন যে, বিমানের প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে মির্জা সাহেবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বা অনিয়মের কোন অভিযোগ ছিল না। তাকে শুধু বলব, যে পত্রিকায় তিনি নিবন্ধটি লিখেছেন ওই পত্রিকাসহ অন্যান্য ওই সময়ের পত্রিকাগুলো যেন পড়ে দেখেন। আমার বক্তব্য হলো, আপনার লেখার স্বাধীনতা আছে। পা-িত্য আছে। আপনি সুলেখকও বটে। তাই লিখুন।
লেখক : সাবেক বৈমানিক ও মুক্তিযোদ্ধা